সংস্কৃতির সাথে যোগাযোগে উত্তরাধুনিকতার সীমাবদ্ধতা
মুসা আল হাফিজ
কয়েকজন তরুণ এলেন। তারা সংস্কৃতিকর্মী। চোখ ও চেহারায় আছে উদ্দীপনা । তারা সংস্কৃতির সাথে যোগাযোগের পথ নিয়ে কথা তুললেন। এক তরুণ প্রশ্ন করলেন , উত্তরাধুনিক একজন চিন্তাবিদ কীভাবে সংস্কৃতির কাছে যান?
প্রশ্নটি ছোট । কিন্তু এর আওতায় আছে অনেক দিক। একজন উত্তরাধুনিক চিন্তাবিদ সংস্কৃতির কাছে যাবার জন্য অনেকগুলো হাতিয়ারে সজ্জিত হন। অনেকগুলো উপাদান নিয়ে তিনি অগ্রসর হন সংস্কৃতির কাছে। তাকে এজন্য গ্র্যান্ড ন্যারেটিভের মুখোমুখি হতে হয়।
উত্তরাধুনিকতা প্রশ্ন ও আপত্তিমুখর এক প্রপঞ্চ। সে আপত্তি তোলে ওভারআর্চিং এর প্রতি। কায়েমী শক্তির তরফে সার্বজনীন সত্য হিসেবে যে আখ্যানকে চাপিয়ে দেওয়া হয়, তার অস্তিত্ব নিয়ে সে প্রশ্ন তোলে। শোষক ও সত্যবৈরী, গণবৈরী শক্তি দেশে দেশে তৈরী করে metanarrative । তাদের গৃহপালিত বুদ্ধিজীবীরা, কবিরা, লেখকরা এই ন্যারেটিভের দ্বারা ঐতিহাসিক অর্থ, অভিজ্ঞতা বা জ্ঞানভাষ্যের নাম করে তাদের জন্য এমন বয়ান তৈরী করে, যাকে মহাসত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। এর মাধ্যমে সেই স্বৈরশক্তি সমাজের উপর নিজের কর্তৃত্বকে বৈধ করে তোলে। উত্তরাধুনিক চিন্তককে এর সাথে লড়তে হবে। উত্তরাধুনিক চিন্তক লড়বেন বটে। কিন্তু হাতিয়ারটা কী? অধিকাংশ উত্তরাধুনিক চিন্তক হাতিয়ার ধার করেছেন বস্তুবাদ, ভোগবাদ বা ভাববাদী বস্তুবাদের ভাণ্ডার থেকে। কিন্তু তা কি যথার্থ হাতিয়ার হতে পারে? এই প্রশ্নের জবাব দেবার আগে উত্তরাধুনিকতা প্রশ্ন করবে যথার্থতা আবার কী? সুস্থির যথার্থতা বলতে কিছু নেই। এর পরের আলাপে সে মেধাবী বখাটের আচরণ করে। যে লড়াই করতে চায়, কিন্তু আদর্শের প্রশ্নে উদাসীন।
দুনিয়া জুড়ে আধুনিকতার খেদমতগার পণ্ডিত ও বুদ্ধিজীবিরা মানব অভিজ্ঞতার সম্পূর্ণতা ব্যাখ্যা করার দাবি করছেন। সেই দাবির উপর আপত্তি উঠেছে নানা দিক থেকে। উত্তরাধুনিক পরিসর থেকে আপত্তি তুলেছেন জাঁ-ফ্রাঁসোয়া লিওটার্ড এবং জিন বউড্রিলার্ডের মতো চিন্তাবিদরা। তারা দেখিয়েছেন যে, নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির সুবিধা নিয়ে আধিপত্যবাদ নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে নিপীড়নের যুক্তি তৈরী করে, কিংবা তাদেরকে প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দেয়। গ্র্যান্ড ন্যারেটিভের প্রতি এই আপত্তি সাংস্কৃতিক ভাষ্য ও নিয়মের মধ্যে প্রসারিত। যার মাধ্যমে ন্যারেটিভের একচ্ছত্রতা নিশ্চিত হয়। উত্তরাধুনিক চিন্তাবিদকে সেই একচ্ছত্রতার বিরুদ্ধে লড়তে হবে।কারণ উত্তরাধুনিকতা সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতার বৈচিত্রের উপর জোর দেয়।
সে সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতাবাদ এবং বহুত্ববাদের পক্ষে অবস্থান নেয়।
উত্তরাধুনিক চিন্তাধারার আগ্রহ সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতার প্রতি। সে তাকে আলিঙ্গন করতে চায়। উত্তরাধুনিকতা কোনো বস্তুনিষ্ঠ মান , ধারণা বা বয়ানের ন্যায্যতাকে অস্বীকার করে, যার দ্বারা সংস্কৃতিকে চূড়ান্তভাবে বিচার করা যায়।
এর বদলে উত্তরাধুনিকতা সংস্কৃতিকে মানুষের অভিব্যক্তি, বিশ্বাস এবং অনুশীলনের বৈচিত্র্যময় জগত হিসেবে দেখতে চায়। সকল সংস্কৃতিকে সমানভাবে বৈধ বলে দাবি করে।দাবিটা সুন্দর। কিন্তু এর প্রয়োগ শুধু জটিল নয়, দু:সাধ্য। মুশকিল হলো এই প্রয়োগের দিশাটা সবচেয়ে বেশি অস্থির, অপ্রস্তুত, অস্পষ্ট।
উত্তরাধুনিক চিন্তাবিদরা সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ উদযাপন করবেন, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উপাদানের সহাবস্থান এবং মিথস্ক্রিয়াকে শ্রেণীবিন্যাস দেবেন, তারা সেটা করবেন কোনো সংস্কৃতিকে অন্য সংস্কৃতির উপর বিশেষাধিকার না দিয়েই। এই দৃষ্টিভঙ্গি পূর্বের চিন্তাধারায় প্রচলিত সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্ব বা শ্রেণিবিন্যাসের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে। যা চমকপ্রদ বটে।
উত্তরাধুনিকতা হাইপাররিয়েলিটি ও সিমুলেশনের মুখোমুখি হয়।তা ইমেজ এবং অনুরূপতার এমন সমন্বয় , যা বাস্তবতাকে বিকৃত করে। কিংবা তা বাস্তবে বাস্তব অস্তিত্বের সাথে কিছু চিত্রিত না করেও বাস্তবতা গঠন করে। সিমুলেশন হল একটি প্রক্রিয়া বা সিস্টেমের অনুকরণীয় উপস্থাপনা, যা বাস্তব জগতে বিদ্যমান থাকতে পারে।
পোস্টমডার্নিজম বউড্রিলার্ডের কাজের মাধ্যমে হাইপাররিয়ালিটির ধারণার সূচনা করে। যা বাস্তবতা এবং সিমুলেশনের মধ্যে রেখার অস্পষ্টতাকে কাজে লাগায় ।
প্রতীক, চিত্র এবং সিমুলেশনগুলি যে বাস্তব বাস্তবতার প্রতিনিধিত্ব করে, একটি অতিবাস্তব সংস্কৃতিতে তারা তার চেয়ে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। এই ঘটনাটি দেখা যায় গণমাধ্যম, বিজ্ঞাপন এবং ভোক্তা সংস্কৃতিতেও। যেখানে উপস্থাপনার মাধ্যমে বাস্তব বাস্তবতার চেয়ে অতিরিক্তি বাস্তবতা তৈরী করা হয়।
ফলে মানুষ বাস্তবতা বলতে যা বুঝে , তা হয় প্রতিপত্তিশালীদের নির্মিত বাস্তবতা। সাজানো বাস্তবতা। মিডিয়া, থিঙ্কট্যাঙ্ক, বিজ্ঞাপনসহ সব ধরণের প্রোপাগাণ্ডা মেশিন এখন প্রকৃত বাস্তবতাকে হত্যা করে হাইপাররিয়েলিটি ও সিমুলেশন তৈরী করছে। যার ফলে সত্যতা লাঞ্চিত হচ্ছে, অপ্রাসঙ্গিক বানানো হচ্ছে তাকে। প্রকৃত সত্যকে অবাস্তব করে তোলা হচ্ছে। মজার ব্যপার হলো সত্যকে লাঞ্চিত করার এই চিত্রকে সামনে দেখে উত্তরাধুনিকতা প্রতিরোধে সচেষ্ট হয় বটে, তবে নানা ভুলের দিকে ধাবিত হয়।
সে পরিচয়ের স্থির ধারণার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় । সে পরিচয়কে অস্থির দেখতে চায় । কিন্তু পরিচয়ের স্থিরতা কি বাস্তবতার বাইরের কিছু? পরিচয়ে যেমন অস্থির দিক আছে, তেমনি আছে স্থির দিকও। ফলে উত্তরাধুনিক চিন্তককে সংস্কৃতির সাথে মোলাকাত করতে হলে পরিচয়-প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। হাইব্রিডিটি এবং ফ্লুইডিটির সাথেও বোঝাপড়া করতে হবে।
ইতিহাস, ভাষা, বিশ্বায়ন এবং প্রযুক্তির মতো বিভিন্ন কারণের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সাংস্কৃতিক পরিচয়গুলিকে ভাবা হচ্ছে হাইব্রিড, দেখানো হচ্ছে সাংস্কৃতিক সত্তাগুলো কৃত্রিমভাবে বিকশিত । জুডিথ বাটলারের মতো উত্তরাধুনিক চিন্তাবিদরা পরিচয়ের কার্যকর প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করেন। তারা যুক্তি দেন, পরিচয় কোনো অন্তর্নিহিত সারাংশ নয়, বরং বারবার আচরণ এবং ন্যারেটিভের বদলের মাধ্যমে সে জন্ম নেয়, তৈরী করে সামাজিক গঠন ও সাংস্কৃতিক সত্তা।
এর মধ্যে সত্য আছে বটে। কিন্তু এটাই সত্য নয়। কিন্তু উত্তরাধুনিকতা নিজের এই উপলব্ধিকে কেন্দ্রে রাখতে চায়। মুশকিল এখানেই। কারণ উত্তরাধুনিকতা নিজেই কেন্দ্র ও প্রতিষ্ঠানবিরোধী।
মিশেল ফুকোর কাজ আমাদেরকে দেখায় যে, কীভাবে প্রতিষ্ঠান ন্যারেটিভ এবং জ্ঞান উৎপাদনের মাধ্যমে কেন্দ্র হয়ে উঠে।ফলে সে সত্য তৈরী করে। যা আসলে নিজের স্বার্থের সত্য, তাকে বানানো হয় সবার সত্য। উত্তরাধুনিকতা দেখায়, কীভাবে প্রভাবশালী ন্যারেটিভগুলো সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়াকে শাসন করে, চিন্তাকে কীভাবে সে গঠন করে এবং আমাদের ভাবনার স্থরগুলোকে কী কী উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করে! সে বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দেয় এবং নিশ্চুপ বানিয়ে দেয়।
উত্তরাধুনিকতা সাংস্কৃতিক অনুশীলনের মধ্যে লুকানো শক্তিকাঠামো উন্মোচন করতে চায় এবং নির্দিষ্ট জ্ঞান ব্যবস্থার কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে।কিন্তু দিনশেষে আধুনিক জ্ঞানব্যবস্থাই উত্তরাধুনিক জ্ঞানব্যবস্থা হিসেবে টিকে যায়। কেবল তাতে নতুন কিছু বিষয় ও শিরোনাম যুক্ত হয়। আধুনিকতাই থাকে তার প্রাণভোমরা । আধুনিকতাই নিয়ন্ত্রণ করে উত্তরাধুনিকতার প্রতিবাদী গলা ও গান।
উত্তরাধুনিকতার প্রকৃতি বিদ্রূপাত্মক। প্যারোডি ও কৌতুকপূর্ণতা তার অন্যতম রীতি। সংস্কৃতির প্রতি আপন দৃষ্টিভঙ্গিতে বিদ্রূপ, প্যারোডি এবং কৌতুকপূর্ণতা ব্যবহার করে উত্তরাধুনিকতা । এই সরঞ্জামগুলি ঐতিহ্যগত নিয়মগুলিকে নষ্ট করতে এবং প্রতিষ্ঠিত অর্থকে চ্যালেঞ্জ করতে ব্যবহৃত হয়। সাংস্কৃতিক আখ্যানের মধ্যে দ্বন্দ্ব বা অসঙ্গতি প্রকাশ করার একটি উপায় হতে পারে বিদ্রূপ। উত্তরাধুনিকতা এর মাধ্যমে স্বীকৃত সত্যের সমালোচনামূলক পুনর্মূল্যায়নের আমন্ত্রণ জানায়।
কিন্তু ঐতিহ্যগত নিয়মকে তিরষ্কার করে উত্তরাধুনিকতা কোন ঐতিহ্য নির্মাণ করবে? কোথায় তার প্রতি-ঐতিহ্য? প্রথার সংস্কার আর প্রথার উচ্ছেদ এক নয়। উত্তরাধুনিকতা বিভিন্ন সংস্কৃতি ও প্রথার প্রতি স্বীকৃতি দিয়েও তাকে আক্রমণ করে, নিন্দা করে, বিদ্রূপ করে। প্রথা ও ঐতিহ্যের নিন্দা কোনো নিষিদ্ধকর্ম নয়। কিন্তু উত্তরাধুনিকতা জানে না, কাকে সে আক্রমণ করবে আর কাকে সে সুরক্ষা দেবে। তার আক্রমণের তরবারি ধারালো। কিন্তু এলোপাথাড়ি ও নির্বিচার।
উত্তর-আধুনিকতাবাদ একটি একক, বস্তুনিষ্ঠ সত্যের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে এবং পরিবর্তে সংস্কৃতির আরও সূক্ষ্ম বোঝাপড়াকে উত্সাহিত করে। সে বিশ্ব সম্পর্কে আমাদের বোঝার গঠনে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিকে জায়গা দিতে চায়। চিন্তাসমূহের জটিলতা এবং শক্তির গতিবিদ্যার প্রভাবের প্রতি মনোযোগী হতে চায়।
এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একজন উত্তরাধুনিক চিন্তক সংস্কৃতির সাথে যোগাযোগ করতে চান।
কিন্তু মুশকিল হলো উত্তরাধুনিক চিন্তা বলতে যা পরিচিত, তা নিজেই বিভিন্ন ব্যাখ্যা ও বৈচিত্রময় দৃষ্টিভঙ্গির দুনিয়া। ফলে বিচিত্র চিন্তার বিকাশ হিসেবে সে স্বীকারযোগ্য হলেও কর্মের কোনো সুস্পষ্ট পন্থা হিসেবে উত্তরাধুনিকতা নিজেকে জাহির ও হাজির করতে পারছে না।
No comments