Musa Al Hafij

 গিয়াসুদ্দীন তুঘলক : দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাষ্ট্রনায়ক

মুসা আল হাফিজ

 

 

ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের শাসনামল গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।  গিয়াসুদ্দীন  ভারতে তুঘলক রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা  ও প্রথম সুলতান। তাঁর প্রকৃত নাম গাজী মালিক। ১২৮১ খ্রিস্টাব্দে দিল্লীর নিকটবর্তী কোটলা শহরে তার জন্ম।  তুর্কি পিতা ও পাঞ্জাবের জাট বংশীয় মায়ের সন্তান ছিলেন তিনি। দিল্লীতে তিনি বেড়ে উঠেন উন্নত সুবিধা ও শিক্ষা-প্রশিক্ষণে। কর্মজীবন শুরু করেন আলাউদ্দীন খিলজির অধীনেতারই সেনাবাহিনীতে। দক্ষ সমরবিদ ছিলেন তিনি। রণাঙ্গণে তার পারদর্শিতা  ছিলো অসাধারণ। মোঙ্গলদের মোকাবেলায় বীরত্ব প্রদর্শন করেন তিনি। ভারতের সীমান্ত রক্ষায় অসামান্য কৃতিত্বের ফলে লাভ করেন গাজী উপাধি। আলাউদ্দিন খিলজির  পরে তার উত্তরসূরি মোবারক খিলজির অধীনেও গিয়াসুদ্দীন দক্ষতার প্রমাণ পেশ করেন।  

 আভ্যন্তরীণ সঙ্কট নিরসনেও তার ভূমিকা ছিলো ব্যাপক। ১৩১৬ সালে   অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেন  আমির খসরু খান। তিনি ছিলেন আলাউদ্দীন খিলজির সাবেক ক্রীতদাস। দিল্লি সালতানাতের ইতিহাসে এটি ছিল একটি উত্তাল সময়। 


গিয়াসুদ্দীন প্রথমে খসরুর সেনাবাহিনীতে চাকুরি   করলেও অচিরেই তার বিরুদ্ধে দাঁড়ান ।  তাকে  সিংহাসনচ্যুত করতে নেতৃত্ব দেন তিনিঅমাত্যবর্গের উপর তার প্রভাব ছিলো প্রতিষ্ঠিত।  খসরু খানের শাসনামলে দিল্লী সালতানাতের চারদিকে যে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়েছিলো, তার প্রতিবিধানের যোগ্য লোক হিসেবে তিনিই বিবেচিত হলেন।  দরবারের অভিজাতরা  ১৩২০ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে সুলতানরূপে সিংহাসনে বসান। তিনি গিয়াসুদ্দীন তুঘলক নাম ধারণ করেন।  শুরু হয় তুগলক বংশের শাসন। ১৩২৫ সালে মৃত্যু অবধি জারি ছিলো তার শাসনকাল। পাঁচ বছরের শাসনামলকে তিনি  রাজনৈতিকপ্রশাসনিক এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়নের কালখন্ডে পরিণত করেন।   তার অবদান  সালতানাতের ইতিহাসে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল।

 

খিলজি রাজবংশের পরবর্তী বছরগুলি অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বঅর্থনৈতিক সমস্যা এবং বিদ্রোহে জর্জরিত ছিলো। গিয়াসুদ্দীন শৃঙ্খলা , ঐক্য ও শান্তি নিশ্চিত করেন। সূচিত  করেন উন্নয়ন ও অগ্রগতির নতুন  কর্মধারা।  

 

১. প্রশাসনিক সংস্কার ও উন্নয়ন : উচ্চাভিলাষী প্রশাসনিক সংস্কারের একটি সিরিজ কর্মসূচি গ্রহণ করেন তিনি।   সাম্রাজ্যের শাসনব্যবস্থার উন্নতির প্রশ্নে তিনি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন ছিলেন এবং তার সংস্কারগুলি  সালতানাতকে  বিভিন্ন সমস্যা থেকে পরিত্রাণ দিয়েছিলো। নমুনা হিসেবে কয়েকটি সংস্কারের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে। 

ক রাজস্ব সংস্কার: রাজস্ব প্রশাসন ব্যবস্থাপনায়  তার  অবদান ছিল অনন্য । খিলজি রাজবংশের পরবর্তী বছরগুলিতে সালতানাত  আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল। গিয়াসউদ্দিন "জাবত" নামে একটি নতুন রাজস্ব ব্যবস্থা চালু করেন। এই ব্যবস্থার অধীনে ভূমি রাজস্ব স্থির করা হয়েছিল এবং নগদ অর্থে রাজস্ব  সংগ্রহ করা হয়, যা রাষ্ট্রকে  আয়ের আরও স্থিতিশীল ক্ষেত্র  প্রদান করে। জমির মানের উপর ভিত্তি করে রাজস্বের হার স্থির  করা হয়েছিল এবং এই ব্যবস্থা রাজস্ব সংগ্রহে আরও সামঞ্জস্য নিশ্চিত করে।  রাষ্ট্র ও জনগণের জন্য তা উপাদেয় বিবেচিত হয়। যা রাজস্ব ব্যবস্থাকে দেয় সেই  দক্ষতা, যা থেকে উপকৃত হয়েছে পরবর্তী ভারত।
 
খ. কৃষি সংস্কার: গিয়াসউদ্দীন কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতেও মনোযোগী ছিলেন। এর  জন্যও অগ্রসর  ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি খাল নির্মাণ এবং অন্যান্য সেচ কাজকে উৎসাহিত করেন, যা কৃষি ফলন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অনাবাদী ভূমি আবাদ, সবুজায়ন ও পানিব্যবস্থাপনায় ছিলো তার দৃষ্টি। এর ফলে শুধু  অর্থনীতি চাঙ্গা হয়, তা নয়, বরং   দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি হ্রাস হয় এবং অধিকতরো  প্রজাকল্যাণী  খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত হয়

. নতুন রাজধানী স্থাপন: গিয়াসউদ্দিন তুঘলক নগরব্যবস্থাপনায়ও অগ্রসর ছিলেন। নিরাপত্তা,  ভূমি, পরিবেশ,প্রতিবেশ ও আবহাওয়া বিবেচনা করে তিনি   তুঘলুকাবাদ শহর প্রতিষ্ঠা করেন একে  নতুন রাজধানী হিসেবে সম্প্রসারিত করেন। তিনি তুঘলুকাবাদের কাছে আদিলাবাদ নামে একটি দুর্গ শহরও প্রতিষ্ঠা করেন। এই শহরগুলির নির্মাণ করেছিলেন  একটি সংগঠিত এবং দক্ষ প্রশাসনের আকাঙ্খা থেকে। যা তার সুদূরপ্রসারি দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফল ঘটায়

. অবকাঠামো উন্নয়ন:
গিয়াসউদ্দিন তুঘলক শিল্প ও স্থাপত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি বেশ কয়েকটি অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেছিলেন যা ভারত উপমহাদেশে  দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল।

. তুঘলুকাবাদের স্থাপত্য ও নগরপরিকল্পনা : তুঘলুকাবাদে  তিনি যে নতুন রাজধানী স্থাপন করেছিলেন, সেটি ছিল চিত্তাকর্ষক এক  স্থাপত্য কীর্তি।  একটি সুপরিকল্পিত বিন্যাস ছিলো শহরে।   একটি বিশাল দুর্গ একে পাহারা দিচ্ছিলো । দুর্গটি ছিলো উঁচু প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত  এবং বেশ কয়েকটি চিত্তাকর্ষক গেটওয়ে এবং জলাধার ছিলো তাতে। তুঘলুকাবাদের মহিমা ছিল দিল্লী সালতানাতের উন্নয়নের বিঘোষক।  এর সর্বত্রই ছিলো  একটি শক্তিশালী ও প্রভাবশালী রাজধানী প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন।তুঘলাকাবাদ দুর্গটি সরিস্কা টাইগার রিজার্ভের সাথে সংযুক্ত যা  একটি গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র্য অঞ্চলকে ঘিরে রয়েছে। এই দুর্গ এবং অভয়ারণ্যের আশেপাশে রয়েছে বিভিন্ন আকর্ষণীয় স্থান। যেমন অনঙ্গপুর বাঁধ, সুরজকুণ্ড জলাশয়বাদখাল হ্রদ , দমদমা হ্রদ ইত্যাদি। 

খ.  পানিব্যবস্থাপনা , দুর্যোগব্যবস্থাপনা  : আগেই বলেছি, গিয়াসউদ্দিন তুঘলক খাল এবং অন্যান্য সেচ ব্যবস্থা নির্মাণে বিনিয়োগ করেছিলেন। এই প্রকল্পগুলি কৃষি উত্পাদনশীলতাকে  উন্নত করে। কূপ নির্মাণ , গভীর জলাধার তৈরী, খাল তৈরী করে দুই নদীর সংযোগ, পানিসঙ্কটে জর্জরিত মরু অঞ্চলে পানি সর্বরাহ ইত্যাদি কর্মসূচি কি আজকের সময়ের প্রয়োজনকেও প্রতিনিধিত্ব করছে না?   তার পদক্ষেপসমূহ  প্রজাদের জন্য একটি স্থিতিশীল খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অপরদিকে বন্যাপ্রবণ এলাকায় বাঁধ নির্মাণ আর খরাপ্রবণ এলাকায় পানি সর্বরাহ কর্মসূচি তুঘলকের সময়কে অতিক্রম করে পরবর্তী সময়ের সঙ্কটেরও সুরাহা দেয়। 

. যোগাযোগ ও  সরাইখানা  নির্মাণ: গিয়াসউদ্দিন তুঘলক বিখ্যাত  কুতুব-বদরপুর রোড নির্মাণ করেছিলেন যা তার নতুন রাজধানী শহরকে  গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের সাথে যুক্ত করেছে। এই রাস্তাটিকে আজ মেহরৌলি-বদরপুর রোড বলা হয়।প্রদেশে প্রদেশে বহু সড়ক তিনি নির্মাণ করেন। সড়ক সমূহের নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন জায়গায় তৈরী করেন সেনাচৌকি।    বাণিজ্য ও ভ্রমণের সুবিধার জন্য সড়কের  ধারে বহু সংখ্যক  সরাইখানা বা "সেরাই" নির্মাণ করেন তিনি। এই সব  সেরাই ভ্রমণকারী এবং ব্যবসায়ীদের জন্য  আশ্রয় বিধান  করতো। তাদের নিরাপত্তা দিতো এবং আন্ত:বিনিময়ের ধারা তৈরী করতো।  সরাইগুলো সাম্রাজ্যের মধ্যে বাণিজ্য ও যোগাযোগের সম্প্রসারণে  গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

. সামরিক অভিযান:
গিয়াসউদ্দিন তুঘলক শুধু একজন প্রশাসকই ছিলেন না, একজন সামরিক কৌশলবিদও ছিলেন। তিনি তার সাম্রাজ্য  সম্প্রসারণ ও সুসংহত করার জন্য বেশ কয়েকটি সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। তার   উল্লেখযোগ্য সামরিক অভিযানের মধ্যে রয়েছে:

.  খসরু খানের বিরুদ্ধে অভিযান: খসরু খানের সাথে মোকাবিলা করা ছিলো তার প্রথম ও প্রধান চ্যালেঞ্জ।  খসরুর  অধীনে এক সময়  তিনি  সেনাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। খসরু খান এর আগে খিলজি রাজবংশকে উৎখাত করে তার শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই শাসন ব্যর্থতা ও বিশৃঙ্খলায় ছিলো জেরবার।  গিয়াসুদ্দিন তুঘলক সফলভাবে খসরু খানকে যুদ্ধে পরাজিত ও হত্যা করেন, যার ফলে সুলতান হিসেবে নিজের অবস্থান নিশ্চিত করেন।

খ. দক্ষিণ ভারতে অভিযান : গিয়াসউদ্দিন তুঘলকও দক্ষিণ ভারতের দাক্ষিণাত্য অঞ্চলে সালতানাতের  প্রভাব বিস্তারে মনোযোগী  ছিলেন। তিনি দাক্ষিণাত্যে অভিযান পরিচালনা করেন  মাদুরাই অঞ্চলে বিজয় সম্পন্ন  করেন।  উপমহাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে ক্ষমতা সুসংহত করার জন্য তার প্রচেষ্টা পরবর্তী তুঘলক রাজবংশকে  দাক্ষিণাত্যের রাজনীতিতে গভীরভাবে  যুক্ত  করে।  

গ. মধ্য এশিয়ায় অভিযান: গিয়াসউদ্দিন তুঘলক মধ্য এশিয়ায় সামরিক অভিযান প্রেরণ করেন।  তিনি  ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে তার প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। তার লক্ষ্য ছিলো এমন সব এলাকায় আধিপত্য নিশ্চিত করা, যা  ঐতিহাসিকভাবে দিল্লি সালতানাতের অংশ ছিল যদিও এই অভিযানগুলো  সম্পূর্ণরূপে সফল হয়নি, তবে তা পুরোপুরি ব্যর্থও হয়নি। অভিযানগুলো  তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং তার শাসন সম্প্রসারণের লক্ষ্যকে প্রচার করেছিল।


. চ্যালেঞ্জ এবং উত্তরাধিকার:
গিয়াসউদ্দিন তুঘলক তার শাসনামলে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। তুঘুলকাবাদের মতো  উচ্চাভিলাষী অবকাঠামো রাজ্যের সম্পদ এবং শ্রমশক্তির উপর একটি ভারী বোঝা চাপিয়েছিল।  দাক্ষিণাত্য ও মধ্য এশিয়ায় সম্প্রসারণবাদী নীতি ছিল ব্যয়বহুল প্রচেষ্টা।
কিন্তু তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ ছিল মঙ্গোল আক্রমণের হুমকি। তরমাশিরিন খানের নেতৃত্বে মঙ্গোলরা ভারতীয় উপমহাদেশে একাধিক অভিযান চালায়। এই আক্রমণগুলি তুঘলক রাজবংশের শাসনের স্থিতিশীলতার জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করেছিল।
গিয়াসউদ্দিন এর মোকাবেলায় ব্যস্ত থাকেন। 
 
গিয়াসুদ্দীন  তুঘলক ১৩২৫ সালে মারা যান  
তার রাজত্বকে উল্লেখযোগ্য উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও সংস্কারের সময় হিসেবে দেখা যায়। তার প্রশাসনিক ও আর্থিক সংস্কার, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং সামরিক অভিযান  সালতানাতের উপর স্থায়ী প্রভাব ফেলে। রাজস্ব সংগ্রহে স্থিতিশীলতা আনতে এবং কৃষি উৎপাদনশীলতা উন্নত করতে তার প্রচেষ্টা সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক মঙ্গলকে নিশ্চিত করে 
সংগঠিত শহর এবং অবকাঠামো প্রকল্পগুলির জন্য তার দৃষ্টিভঙ্গি ভবিষ্যতের জন্য মঞ্চ তৈরি করে

No comments

Theme images by merrymoonmary. Powered by Blogger.